Ticker

6/recent/ticker-posts

বাংলায় দূর্গা পূজার আসল ইতিহাস ও অজানা তথ্য

 

🎉 বাঙালির উৎসব: দূর্গা পূজার ইতিহাস ও বিবর্তন🎉 

লেখিকা: মৈত্রী রায় 

"আজকের দূর্গা পূজা আধুনিকতা ও প্রাচীন ঐতিহ্যের সমন্বয়ে গঠিত, যেখানে আচার-অনুষ্ঠানগুলির গভীরতা মিশে থাকে আধুনিকতার স্পন্দনে।"


বাংলায় দূর্গা পূজার আসল ইতিহাস ও অজানা তথ্য
বাংলায় দূর্গা পূজার আসল ইতিহাস ও অজানা তথ্য
 

দূর্গা পূজা বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম উল্লেখযোগ্য উৎসব হিসেবে গণ্য হয় এটি কেবল ধর্মীয় উৎসব নয়, বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক জীবনেও গভীর প্রভাব ফেলেছে পূজার সময়ে বাংলার গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত সকল স্তরের মানুষ আনন্দ, উৎসব এবং ঐতিহ্যে মেতে ওঠে এই নিবন্ধে আমরা দূর্গা পূজার ইতিহাস এবং বর্তমান সময়ের উদযাপনের বিস্তারিত আলোচনা করব


১. দূর্গা পূজার ইতিহাস:

দূর্গা পূজার ইতিহাস বহু প্রাচীন। মূলত এটি দেবী দূর্গার মহিষাসুরকে বধ করার পৌরাণিক কাহিনীর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন পুরাণ শাস্ত্রগুলিতে দেবী দূর্গাকে মহাশক্তি মা রূপে পূজিত করার কথা রয়েছে। বাংলায় দূর্গা পূজার সূচনা সম্পর্কে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে। তবে সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, বাংলায় দূর্গা পূজার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৬ শতকের কাছাকাছি সময়ে। জমিদার সমাজের প্রবর্তিত পূজাগুলি পরে সাধারণ মানুষের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ শাসনকালে পূজাটি শহুরে বাঙালি সমাজে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এক অংশে পরিণত হয়

  • পূজার সূচনা এবং জমিদার প্রথা: জমিদাররা তাদের প্রজাদের জন্য বিশাল আয়োজন করে দূর্গা পূজা উদযাপন করতেন। একদিকে তারা তাদের সামাজিক এবং ধর্মীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতেন, অন্যদিকে এই পূজার মাধ্যমে প্রজাদের সঙ্গে একাত্মতা স্থাপন করতেন

  • ব্রিটিশ যুগের দূর্গা পূজা: ব্রিটিশ শাসনের সময়ে এই পূজা শহরাঞ্চলে বিশেষ জনপ্রিয়তা পায়। এই সময়কার পূজা অনেকটা বৈশিষ্ট্যগতভাবে আজকের থিম পূজার মতো, যেখানে প্যান্ডেলের চমৎকার সাজসজ্জা এবং পূজার বড় আয়োজন ছিল আকর্ষণীয় বিষয়


২. পূজার আচার-অনুষ্ঠান:

দূর্গা পূজা মূলত চার দিনব্যাপী উদযাপিত হলেও, আসল প্রস্তুতি প্রায় এক মাস আগে থেকেই শুরু হয়। প্রতিটি দিনের নিজস্ব আচার এবং অনুষ্ঠানের তাৎপর্য রয়েছে

  • মহালয়া: মহালয়ার দিন দেবী দূর্গাকে আমন্ত্রণ জানানোর দিন। এই দিনে বীরদের আত্মা শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় এবং দেবীর মহিষাসুরমর্দিনী রূপের কাহিনী রেডিওতে প্রচারিত হয়, যা বাঙালির জন্য এক বিশেষ আবেগপূর্ণ মুহূর্ত

  • ষষ্ঠী থেকে দশমী: ষষ্ঠীর দিন দেবীর মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমী দিনে বিভিন্ন আচার পালিত হয়, যার মধ্যে অঞ্জলি, কুমারী পূজা, সান্ধ্যা আরতি অন্যতম। দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়, যা বাংলার সমাজে বিদায়ের বিষাদপূর্ণ মুহূর্ত

  • সিঁদুর খেলা এবং বিসর্জন: সিঁদুর খেলা মহিলাদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ। বিসর্জনের সময় ভক্তরা তাদের প্রিয় দেবীকে বিদায় জানায় এবং পরবর্তী বছরে আবার তার আগমনের আশায় অপেক্ষা করে


৩. দূর্গা পূজা বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি:

দূর্গা পূজা বাংলা সাহিত্যে, সংগীতে এবং শিল্পকলায় অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবৃত হয়েছে। বিখ্যাত সাহিত্যিক কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্বদের রচনায় পূজার প্রভাব দৃশ্যমান

  • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূজা বন্দনা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বহু কবিতা গানে দেবী দূর্গাকে মহাশক্তি রূপে বন্দনা করেছেন। তাঁর লেখা গানগুলি আজও দূর্গা পূজার সময় সংগীত অনুষ্ঠানে প্রধান আকর্ষণ হয়ে থাকে

  • কথাসাহিত্য এবং নাটক: বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন উপন্যাস এবং নাটকে দূর্গা পূজাকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ এবং শহুরে জীবনের বিভিন্ন দিক ফুটে উঠেছে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচনায় গ্রামবাংলার পূজার আবহ এবং মানুষের আবেগের কাহিনী সুন্দরভাবে উঠে এসেছে

"মহালয়ার মাহাত্ম্য"


৪. দূর্গা পূজা সামাজিক সম্পর্ক:

দূর্গা পূজা শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি সমাজের প্রতিটি স্তরে বন্ধন এবং সম্পর্কের শক্তিকে দৃঢ় করে। পাড়া বা ক্লাবভিত্তিক পূজা বাংলার সামাজিক জীবনে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে প্রাচীন প্রজন্মের মেলবন্ধন ঘটায়

  • পাড়ার পূজা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি: পূজা শুধু হিন্দুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। বাংলার অনেক জায়গায় মুসলিম ভাইয়েরাও পূজার আয়োজন এবং অনুষ্ঠানে অংশ নেন। এই সময়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায়

  • শহর বনাম গ্রাম: শহরের পূজা সাধারণত অত্যন্ত আধুনিক এবং প্রদর্শনীমূলক হয়ে থাকে, যেখানে প্যান্ডেল থিমের গুরুত্ব বেশি। গ্রামীণ এলাকায় পূজা মূলত একত্রিত সামাজিক অনুষ্ঠানের রূপ নেয়, যেখানে ঐতিহ্যবাহী আচার এবং সামাজিক বন্ধন বড় ভূমিকা রাখে


৫. পূজার অর্থনৈতিক প্রভাব:

দূর্গা পূজা শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় দিক থেকে নয়, অর্থনৈতিক দিক থেকেও বাংলার সমাজে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। পূজার সময় প্রচুর বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়, যার মধ্যে পোশাক, খাদ্য, এবং অন্যান্য পণ্য বিক্রির ব্যাপক প্রবাহ দেখা যায়

  • ফ্যাশন এবং কেনাকাটা: পূজার আগে নতুন পোশাক কেনা এবং সেজেগুজে পূজা মণ্ডপে যাওয়া একটি অন্যতম বড় সামাজিক প্রথা। পূজার জন্য নতুন ডিজাইনের পোশাক এবং গয়না তৈরি হয়, যা স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে

  • মেলা এবং দোকানপাট: পূজার সময় বিভিন্ন জায়গায় মেলা আয়োজন করা হয়, যেখানে স্থানীয় শিল্পীরা তাদের পণ্য বিক্রি করেন। এতে ক্ষুদ্র এবং কুটির শিল্পের বিকাশ ঘটে, যা গ্রামের অর্থনীতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখে


৬. আধুনিক দূর্গা পূজা:

বর্তমান সময়ে দূর্গা পূজার উদযাপন অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। এখন থিম পূজা, পরিবেশবান্ধব প্রতিমা এবং ডিজিটাল মাধ্যমের সাহায্যে পূজার প্রচার অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে

  • থিম পূজা: আধুনিক সময়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো থিম পূজা। প্রতিটি পূজা মণ্ডপে আলাদা আলাদা থিমের ভিত্তিতে সাজানো হয়। মণ্ডপগুলিতে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক শিল্পকলার মেলবন্ধন দেখা যায়

  • পরিবেশবান্ধব পূজা: আজকাল প্রতিমা তৈরি এবং বিসর্জনের সময় পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য মাটি এবং প্রাকৃতিক উপকরণের ব্যবহার বাড়ছে

  • ডিজিটাল যুগের পূজা: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে পূজার লাইভ সম্প্রচার এখন অত্যন্ত জনপ্রিয়। এতে মানুষ দূর থেকে পূজার আনন্দ উপভোগ করতে পারে

"দুর্গাপূজা বাঙালি সংস্কৃতি "


৭. দূর্গা পূজার সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব:

দূর্গা পূজা কেবল আনন্দ এবং উৎসবের বিষয় নয়, এটি মানুষের মানসিক এবং সামাজিক অবস্থানকে সমৃদ্ধ করে। পূজার সময় অনেক মানুষ একত্রিত হয়, যার ফলে সামাজিক বন্ধন মজবুত হয়। এছাড়াও পূজার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসে

  • নতুন প্রজন্মের সঙ্গে মেলবন্ধন: বর্তমান প্রজন্মের বাচ্চারা দূর্গা পূজার মাধ্যমে তাদের পূর্বপুরুষদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হয়। এতে তাদের মধ্যে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়

  • উৎসবের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব: পূজা মানুষের মধ্যে আশা এবং আনন্দের সঞ্চার করে। এটি জীবনের একঘেয়েমি থেকে মানুষকে বের করে নিয়ে আসে এবং তাদের নতুন উদ্যমে পরিপূর্ণ করে তোলে


উপসংহার:

দূর্গা পূজা কেবল ধর্মীয় উৎসবই নয়, এটি বাংলার সংস্কৃতির এক অন্যতম মূল স্তম্ভ। পূজার দিনগুলিতে বাংলার সমাজের সকল স্তরের মানুষ একত্রিত হয়ে উৎসবে মিলিত হয়। পূজা শুধু প্রাচীন ঐতিহ্য নয়, এটি একটি জীবন্ত সাংস্কৃতিক প্রবাহ, যা আগামী প্রজন্মের জন্য বাংলা সংস্কৃতির সজীব প্রতীক হিসেবে থাকবে

"বাংলার ঐতিহ্যকে বহন করে দূর্গা পূজা, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে শ্রদ্ধা ভালোবাসার সঙ্গে উদযাপিত হয়ে আসছে।"

 

❓ FAQ (প্রশ্নোত্তর)

১. বাংলায় দূর্গা পূজা কবে শুরু হয়েছিল?
👉 প্রায় ১৬ শতকের জমিদার সমাজে এর সূচনা হয়েছিল বলে মনে করা হয়।

২. মহালয়ার দিন কেন বিশেষ?
👉 এই দিনে দেবীকে পৃথিবীতে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং দেবীর মহিষাসুরমর্দিনী রূপের কাহিনী শোনা হয়।

৩. আধুনিক পূজায় সবচেয়ে বড় পরিবর্তন কী?
👉 থিম প্যান্ডেল, পরিবেশবান্ধব প্রতিমা এবং ডিজিটাল সম্প্রচার।

৪. দূর্গা পূজার অর্থনৈতিক গুরুত্ব কী?
👉 ফ্যাশন, কেনাকাটা, মেলা ও কুটির শিল্পকে কেন্দ্র করে এটি অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে।


💥যদি এই নিবন্ধটি ভালো লাগে তবে শেয়ার করুন আপনার বন্ধুদের সাথে
💥 কমেন্টে লিখুনআপনার প্রিয় দূর্গা পূজার স্মৃতি কী?
💥 বাংলা সংস্কৃতি নিয়ে আরও পড়তে আমাদের ডিজিটাল পেন্সিল ব্লগ এবং প্রতিভা মঞ্চ চ্যানেল   ভিজিট করুন


                                                                                                           


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

Mrs. Moytri Roy বলেছেন…
পড়ে খুব ভালো লাগল, অনেক কিছু জানতে পারলাম